আমি গল্প লিখি। তবে লেখক না,শখের বশে লিখি আর কি। ছোটগল্প লিখি, কিন্তু বই লেখারও স্বপ্ন আছে।
আমার আর ইতির সম্পর্কটা কিভাবে কিভাবে হলো—তা নিয়ে একটা ছোটগল্প লিখতে চাচ্ছি।কিন্তু কোত্থেকে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। প্রথম দিন থেকে শুরু করা যাক:
সেদিন আমাদের বাড়িতে কি একটা অনুষ্ঠান ছিল মনে পড়ছে না,কিন্তু আসল কথা অনুষ্ঠান ছিল। তো আমি অনুষ্ঠান শেষে প্যান্ডেলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম।তখন বোধহয় বিকেল।বিকেলবেলায় আমাদের এইদিকে অনেকেই হাঁটতে আসে।কিন্তু সেদিন আমাদের পাড়ার মেয়েদের মধ্যে একটা অচেনা মেয়েকে আমি দেখতে পেয়েছিলাম।এর আগে আর কখনো দেখি নি।এটা ছিল প্রথম দেখা।
পরেরদিন বিকেলে আবার হাঁটতে এসেছিল।তাদের মধ্যে কথা বলাবলি শুনে বুঝলাম মেয়েটার নাম ইতি।আমি কিন্তু তাদের কথা কান পেতে শুনি নি!আসলে আমিও রাস্তায় হাঁটছিলাম তখন,মেয়েগুলো যখন আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো তখনই শুনলাম। এটা ছিল দ্বিতীয় দেখা। তখনও আমার মনে ওর জন্যে কোনো অনুভূতি জন্মে নি।কিন্তু তৃতীয় দেখাতে ব্যাপারটা জন্মে গেছে।
তো,যেদিন তৃতীয় দেখা হয়েছিল,সেদিন ছিল আমাদের বাড়িতে পুজো—আমাদের বাড়িতে আগে অনেকগুলো পুজো হতো।কি পুজো ছিল এটাও ঠিক মনে নেই। সেদিন হয়তো পাড়ার সবাইকেই নেমন্তন্ন দেয়া হয়েছিল। ওই অচেনা মেয়েটা মানে ইতিও আমাদের বাড়ির পুজোতে এসেছিল। ইতি যে বাড়ির আত্মীয়,ওই বাড়িতেও নেমন্তন্ন দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাড়িটা কোনটা জানতাম না—তখন জানবার প্রয়োজনও ছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদে তা প্রয়োজন হয়ে উঠলো।ইতি যখন পুজোতে আসলো,তখন ওকে দেখে আমার মনটা জানি কেমন করে উঠলো।কিছু বুঝলাম না,কেন জানি এমন হলো।প্রথম প্রথম মনে হয় এমনই হয়।
তখনই মনে হয় ইতির জন্যে আমার মনে অনুভূতি জন্মেছিল—আমার অজান্তেই।
এমনভাবেই দেখা হতে থাকলো ওর সাথে। এতক্ষণ ধরে বলছি যে,ওর সাথে দেখা হচ্ছে। আসলে তো শুধু আমি ওকে দেখেছিলাম
প্রথমদিন,দ্বিতীয়দিন,তৃতীয়দিন–এভাবে।কিন্তু ও তো আমাকে চিনতোও না। আর ও তো আমার দিকে কখনো তাকায়ও নি।তাও আমি ওটাকেই দেখা মনে করে নিয়েছিলাম।
আমার ওকে ভালো লাগতে শুরু করেছিলো।কিন্তু তখনও ও আমাকে চিনতো না—না কখনো আমার দিকে তাকিয়েছিল।তার মানে এই নয় যে,আমি ওর পিছনে লেগে থাকতাম!যখনই দেখা হতো,ওর দিকে একটু তাকালেই আমার ভালো লাগতো। সবদিন আবার আসতো না–মাঝে মাঝে আসতো আর কি।আমি না চাইতেও ওকে আমার ভালো লাগছিলো। ও যেদিন আসতো না সেদিন আমার কেমন জানি লাগতো—খারাপই লাগতো না কি লাগতো বুঝতাম না!
ইতি যখন আমার দিকে প্রথম তাকিয়েছিলো তখন ওর সাথে আমার বারোতম দেখা। প্রতিদিন তো আর আসতো না, কিন্তু দেখার হিসেবে ওটা ছিলো বারোতম।
অনেকসময় ও হাঁটতে আসলেও ওর সাথে আমার দেখা হতো না। আমি তো আর জানতাম না ও কখন আসে,না আসে।কিন্তু অনেকসময় আমিও হাঁটতে যেতাম আর ইতিও হাঁটতে আসতো—তখনি দেখা হয়ে যেতো।
ঠিক এইভাবেই বারোতম দেখার দিনে আমি হাঁটতে বের হয়েছিলাম।জানতাম না ও আসলো কি না।তবু মনে একটা আশা থাকতো–হয়তো আসতে পারে। তো,যখন হেঁটে ওর কাছ দিয়ে যাচ্ছিলাম ও আমার দিকে প্রথম তাকিয়েছিলো।তখন অবশ্য জানতাম না ও কি আমার দিকেই তাকিয়েছিলো না অন্য কোথাও!পিছনে তাকিয়ে দেখলাম আর কেউ আমার পিছনে ছিলো কি না—কিন্তু কেউ ছিল না আমার পিছনে। ও আমার দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে ছিলো।তখন মনে করেছিলাম—মানুষ তো অনেকসময় অন্যমনস্ক হয়ে একদৃষ্টে একজায়গায় তাকিয়ে থাকতেই পারে।আমি তখন অন্যদিকে হেঁটে চলে গেলাম। পিছন ফিরে দেখলামও না ও কি আমার দিকে তখনও তাকিয়েছিলো কি না।কিন্তু সত্যি বলতে কি,আমি নিজে থেকেই ভেবে নিয়েছিলাম যে,ও আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলো!
অনেকবারই মানে যখন দেখা হতো ইতি আমার দিকে মাঝে মাঝেই তাকাতো।ঠিক বুঝতাম না,আমার দিকেই তাকাতো না অন্য কোথাও। কিন্তু আমি তো ভেবে নিয়েছিলাম যে,ও আমার দিকেই তাকাচ্ছে!ভেবে ভেবে ভালোই লাগতো।
মাঝে মাঝে ইতি আসতো না। প্রথম প্রথম প্রতিদিনই আসতো,কিন্তু তারপর থেকে অনেকদিন পর পর হাঁটতে আসতো। ইতি যখন আসতো না,তখন আমার মনটা খারাপও লাগতো না আবার ভালোও লাগতো না—তখন কেমন জানি লাগতো!আমি ওর বাড়িও চিনতাম না,যার কারণে ওদের বাড়ির কাছেও যেতে পারতাম না।
হয়তো ইতি বাড়ির কাছেই হাঁটা-হাঁটি করতো।বাড়িটা চিনলে তো,ওখানে যেতে পারতাম—তখন হয়তো ওকে এক ঝলক দেখতে পারতাম।
একদিন একটা কাকতালীয় ব্যাপার ঘটেছিল।আমি কোথা থেকে যেন আসছিলাম—আমি জানতামও না এমন একটা ব্যাপার ঘটবে।অনেকদিন ধরে ইতি আমাদের এইদিকে আসছিলো না–কিন্তু কিছু করার ছিল না আমার।
আমি জানতাম না ওর সাথে আমার দেখা হয়ে যাবে।হেঁটে আসছিলাম তখন হঠাৎ দেখি ইতি রাস্তায় ব্যাডমিন্টন খেলছিলো ওর আত্মীয়ার সাথে। ওর আত্মীয়াকে আমি চিনাতে বুঝে গেলাম ও কোন বাড়ির আত্মীয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে তখনও ইতি আমার দিকে তাকিয়েছিলো।মানে আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সেদিন থেকে আমার মনে হতে থাকলো সবাই আমার দিকে তাকিয়ে থাকে!আমি ভাবতাম,আমাকে কি পাগল-টাগলের মতো লাগে নাকি!ব্যাপারটা অনেকদিন পর্যন্ত চললো।
আমি মাঝে মাঝেই ওই রাস্তা দিয়ে হাঁটবার সময় বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম,যদি একবার দেখা হয়ে যায়।
আমি মনে মনে ভাবতাম,ওকে তো আমার ভালো লাগে ঠিকই কিন্তু আমি তো ওকে কখনো বলতে পারবো না আর বললেই বা কি?ও যদি না মানে?
আগে অনেকবার শুনেছি—কাউকে যদি কারও ভালো লাগে কিন্তু বলতে পারে না তখন খুবই কষ্ট হয়।আমি বলতাম এসব কি ফালতু কথা বলে–এতে আবার কষ্ট পাওয়ার কি আছে?
এখন বুঝি,একটু খারাপ লাগেই।একটু না আসলে অনেকটা।কিন্তু তার মানে এই নয় যে,আমি মরে যাবো,এই করবো-সেই করবো।এসব ফালতু কাজ করে লাভ কি?এটা ঠিক যে, মনে একটা কষ্ট সবসময় থেকে যাবে।কিন্তু আমি মরে গেলে আমার পরিবারের কি হবে,মরে যাওয়াটাই তো সব না।মরে তো কোনো লাভও হচ্ছে না।
আমার ভেতর জ্ঞানী জ্ঞানী একটা ভাব ছিল।
আবার আমার আরেকটা ভাবনাও ছিল।ভাবতাম যে,হতেও পারে আমি ওকে সাহস করে সব বলে দিতে পারি। আর ও হয়তো আমাকে মেনে নিতে পারে।এসব ভাবনা আমার ভেতর চলতেই থাকতো।এসব ভাবনাগুলোকে কাজে লাগিয়ে আমি চার-পাঁচটা গল্পও লিখেছিলাম।দু-চারটে কবিতাও লিখেছিলাম।যদি প্রথম ভাবনাটা থেকে যেতো তাহলে গল্প আর কবিতাগুলো হতো স্মৃতি। আর যদি দ্বিতীয় ভাবনাটা সত্যি হয়ে যেতো তাহলে গল্প আর কবিতাগুলো ওকে শুনাতাম—ওর রিয়েকশনটা কেমন হতো দেখতাম।আরেকটা কথা ওকে জিজ্ঞেস করতাম,ও যে তাকিয়ে থাকতো,আমার দিকেই তাকাতো নাকি অন্য কোথাও?
তো,দ্বিতীয় ভাবনাটা সত্যি হওয়ার প্রথম ধাপ শুরু হয়েছিল সীমাকে দিয়ে। সীমা ইতির কেমন বোন জানি।
সীমা জানতো আমি বই-টই পড়তাম।ও আমার কাছ থেকে বই ধার নিতে এসেছিলো ওর বোন মানে ইতির জন্যে। ইতিও নাকি বই পড়তে ভালোবাসতো।সীমা আমার কাছ থেকে বই ধার নিয়ে যেতো আবার পড়া শেষ হলে ফেরত দিয়ে যেতো।
ইতির সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো সীমা।
সীমা আর ইতি আমার কাছ থেকে বই নিয়ে যেতো আবার পরেরদিনই ফেরত দিয়ে যেতো।বই পড়ার খুব শখ ছিল।
আমার কাছে অনেক বই ছিল। তাই আমি ওদেরকে বললাম ওরা যাতে বই পছন্দ করে নিয়ে যায়।তখন থেকে ওরা-ই বই পছন্দ করে নিয়ে যেতো।এটা ছিল প্রথম পরিচয়।
সীমাকে তো আমি চিনতাম-ই। আর ইতির সাথেও আমার পরিচয় হয়ে গেলো। চিনা-পরিচিতা হয়ে গেলো। তখন আমি ওকে সাজেস্ট করতাম, এই বইটা পড়তে পারো-ওই বইটা পড়তে পারো ইত্যাদি ইত্যাদি।
তো,এইভাবে আস্তে আস্তে বন্ধত্ব হলো।আমিও কিভাবে জানি কথাটা ওকে সাহস করে বলে ফেললাম।তারপর যা হয়েছিল তা ছিল আমার কল্পনার বাইরে।আমি ভাবতেও পারি নি এমনটা যে হবে।
***************
ইতি এখন আমার স্ত্রী। আসলেই আমি ভাবতে পারি নি যে এমনটা হবে।
ইতিকে আমি গল্প ও কবিতাগুলো শুনিয়েছি।ইতি আমাকে বলে,কেন আমি কথাটা ওকে আগে বলি নি?
আমার গল্পের বেশিরভাগই নায়ক নায়িকার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে যায়।আসলে আমার বেশিরভাগ গল্প-ই আমার প্রথম ভাবনাটা থেকে লিখা তো!
ইতি গল্পগুলো পড়বার সময় হাসতে হাসতে লাল হয়ে যায়। হাসার কারণটা হলো,আমি যে ওকে নিয়ে এসব ভাবতাম আর এমন গল্প লিখতাম—ও এটা কল্পনা-ই করতে পারে না। কিন্তু সত্যি বলতে, তখন ওর চেহারাটা দেখার মতো।ওর দিকে আমি তখন একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি।
ভাবছি আমার আর ইতির গল্পগুলোকে নিয়ে একটা বই লিখে ফেলবো—দারুণ একটা রোমান্টিক উপন্যাস হবে।ছোটগল্প তো অনেক লিখেছি।
আমি যখনই ইতিকে ওই কথাটা জিজ্ঞেস করি যে,ও কি আমার দিকেই তাকাতো না অন্য কোথাও?নাকি তখন আমাকে পাগলের মতো লাগতো? ও তখন শুধু ছোট্ট একটা হাসি দেয়।কিছু বলে না।
আজ পর্যন্ত ও আমাকে এর উত্তর দেয় নি।
এই ছোট্ট হাসিটার মানে আমি এখনও ঠিক বুঝলাম না।
১টি মন্তব্য
Nipendra Biswas
৩ বছর আগে
এই ছোট্ট হাসির মানে কী????🤔
মন্তব্য লেখার জন্য আপনাকে অবশ্যই লগ ইন করতে হবে