![রাত](https://api.kathika.org/images/190x110/43be3887b46ee728bb1b58e455419342.jpg)
সোউউ… করে একটা অটো চলে গেলো সিকনের সামনে দিয়ে। সে রাস্তার ধারে বসে আছে। তার মতো একটা ছেলের রাতের বেলা রাস্তার ধারে বসে থাকা আশ্চর্যের ব্যাপার। রাত অবশ্য বেশি হয়নি সবে নয়-টা বাজে। সে যে রাস্তার ধারে মাটিতে বসে আছে তা নয়। সে রাস্তার ধারের একটা মোদি দোকানের বেঞ্চিতে বসে আছে। রাত বেশি না হলেও আশেপাশের সব দোকান বন্ধ। মাঝে মাঝে পাহাড়াদার এসে সব দোকান দেখে যাচ্ছে সিকন বসে অপেক্ষা করছে। কোনো মানুষের জন্যে অপেক্ষা নয়, অপেক্ষা করছে রাত শেষ হওয়ার। রাত শেষ হলেই সে রওনা দেবে। তবে অপেক্ষার মাঝেও সে একটা আনন্দ খুজেঁ পেয়েছে। শীত চলে এসেছে, ঠান্ডার একটা রেশ আছে বাতাসে। একটা দারুন গন্ধ আছে। বাতাসের ঝাপটা যখন মুখে এসে লাগে তখন তার মনে অনেক আনন্দের সৃষ্টি হয়। সে ভাবতে থাকে এই পরিবেশটা যদি এখানেই থেমে যায়। সারাজীবন যদি এমনি থাকে তাহলে মন্দ হয়না। এই আনন্দের মাঝে হঠাৎ তার মনে ভয়ের কালো ছায়া ছড়িয়ে পরে। ভয়টা আসছে রাস্তা দিয়ে চলতে থাকা সাদা আলখাল্লা পরা লোকটা থেকে। তার এখন মনে পরছে ছোট বেলায় শোনা একটা কাহিনীর কথা। সে শুনেছিল ঈদগাহ্ ময়দানের জায়গাটা ভালো না। সেখানে একটা হুজুর থাকে। যে রাতের বেলা বের হয় আর কাওকে একা পেলে ঘাড় মটকে মেরে ফেলে ।
সিকন এগুলোতে বিশ্বাস করে না। কিন্তু কাকতালীয় ভাবে সে একটা ঈদগাহ্ ময়দানের পাশেই বসে আছে আর তার সামনে যে লোকটা আছে রাস্তার অন্য পাশে সে হুজুরদের মতো দেখতে। আর আশেপাশের পরিবেশটা এতোই নিরব যে তাকে ভূতে বিশ্বাস করতে বাধ্য করছে। রাস্তা দিয়ে যাওয়া লোকটা হঠাৎ থামলো। এতে সিকনের ভয় আরো বেড়ে গেলো ..কিন্তু শেষ পর্যন্ত তেমন কিছুই হলো না। লোকটা সিকনকে দেখলোও না। সোজা হেটে চলে গেলো। শুধু শুধু ভয় পেলো সিকন।।
শব্দ হচ্ছে..!! কিসের শব্দ উপলব্ধি করার আগেই গার্মেন্সের বাস চলে এলো। বাস ভর্তি গার্মেন্স-কর্মী। প্রায় সবই মধ্য বয়সী নারী। আবার কেউ কেউ কিশোরী। সিকন এক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সিকনের মনে কোনো চিন্তা নেই এখন। কে বেশি সুন্দর কার মুখে মায়া মায়া ভাব বেশি এগুলোর কিছুই তার মনে এখন জায়গা নিচ্ছে না । সে শুধুই তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। দেখতে দেখতে বাস চলে গেলো।
এবার একটু নরেচরে বসে ভাবতে লাগলো সে।
কেমন আজব জীবন। সকালে সেই চলে যাও আর রাতে ফিরে এসে খাবার খেয়ে ঘুমাও। ব্যাস এতটুকুই..!!
সিকন এটা ভেবে কতক্ষন পার করেছে সে জানে না। সে হঠাৎ চমকে উঠলো আর ঘড়ির দিকে তাকালো । ঘড়িতে এখন পৌনে বারোটা বাজে। সামনে একজন মধ্য বয়সী লোক দাড়িয়ে একটা ঠিকানা জিজ্ঞাসা করছে। সিকন লেকটাকে খেয়ালই করেনি। খেয়াল করলে হয়তো তখন ঘড়ির দিকে তাকাতো না । সে লোকটা আবারও জিজ্ঞাসা করলো…
- শিমুলীয়া বাজারটা কোন দিকে ?
সিকন এবার তার কথা শুনলো আর একটু ভেবে ভললো..
- শিমুলীয়া বাজার তো এখান থেকে অনেক দূর।
- আচ্ছা, কোন দিকে?
- এই দিক দিয়ে চলে যান সামনে মোড় আসবে সেখান থেকে ডান দিকে যাবেন।
- আচ্ছা ধন্যবাদ। আসসালামুয়ালইকুম।
বলে লোকটা চলে গেলো। সিকন সালামের উত্তর দিলো লোকটা চলে যাওয়ার পর। সালাম দেওয়ার অভ্যেস সিকনের আছে কিন্তু কেউ সালাম দিলে তার উত্তর দিতে সিকনের বেশ ভাবতে হয়। শীত শুরুর দিকে হলেও এখন বেশ ঠান্ডা বাতাস বইছে। গলা থেকে মাফলার হাতে নিয়ে কানের দিকটা ভালো করে ঢেকে নিলো সিকন ।
কুকুরের কান্নার শব্দে সিকনের ঘুম ভাঙলো। দোকানের বেঞ্চিতে এতোক্ষন সে ঘুমিয়ে ছিলো সে। অল্প ঠান্ডায় বেশ গভীর ঘুমে আচ্ছন্য ছিলো সে। কুকুরের এমন দুঃখ মিশ্রিত কান্না যদি কানে না আসতো । তাহলে বোধহয় ভোরেই জাগতো সিকন। কিন্তু ঘুম ভেঙেছে, এখন আর ঘুম আসবেনা তার। বাকি রাত জেগে কাটাতে হবে। ঘড়ির দিকে সে তাকালো.. খুব বেশি সময় অতিবাহিত হয়নি। ঘড়িতে এখন ১টা বেজে ২০ মিনিট। কুকুরগুলোও এখন বেশ শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। সিকন মনে মনে ভাবছে.. রাত্রি বেলা কি এমন হয় কুকুরের, যে তারা দল বেধে কাদেঁ । আর এমন ভাবে কাদেঁ যে মনের মধ্যে বড় ধরনের ভয় জেগে উঠে।
পাখির কলরব শোনা যাচ্ছে। ভোর হতে এখনো ঢের দেড়ি। তবুও পাখির কলরব শোনা যাচ্ছে। আশেপাশের পরিবেশ এমন হয়েছে যেনো ভোর হতে দেড়ি নেই । তবে ঘড়িটা দেখলে সঠিক সময়ের আভাস পাওয়া যায়। কোন কোন পাখি কলরব করছে এখন? নিজেকেই প্রশ্ন করছে সিকন আবার মনের মধ্যে নিজে থেকেই উত্তর দিচ্ছে। খুব বেশি পাখির নাম সে জানে না। চোখের সামনে দেখা পরিচিত পাখির নাম ভাবছে সে। শালিক ডাকছে হয়তো । তা না হলে ঘুঘু হবে। কাক হবে না ..কাকের ডাক আরো জোড়ালো হতো। ময়না কিংবা টিয়াও হবে না।
শেষ রাতের দিকে আকাশে একটু কালো মেঘ জমেছে। সিকন এটা লক্ষ্যই করতো না যদি আকাশ ফুরে চাদেঁর আলো না আসতো । খুব বেশি আলো আসছেও না । পূর্ণিমা টলে গেছে হয়তো তিন-চারদিন আগে। তবে কালো মেঘের জন্যে ফালি হওয়া চাঁদটাকেও সুন্দর দেখাচ্ছে। সিকন চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে আর আনমনে ভাবছে । কোনো বিশেষ মানুষের কথাই ভাবছে সে। চাঁদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক বোধহয় সৃষ্টির শুরু থেকেই । অনেক কবিই চাঁদ সম্পর্কে লিখেছেন। চাঁদের সুন্দর্য নিয়ে লিখেছেন। লিখেছেন তাদের প্রেমিক/প্রেমিকা সম্পর্কে। হয়তো চাঁদকে দেখেই ভালোবাসার মানুষের কাথা মনে পরে। সিকনেরও হয়তো মনে পরেছে তার ভালোবাসার মানুষের কথা।যে বিশেষ মানুষের কথা সে ভাবছে সে হয়তো ভালোবাসার মানুষ।
পূর্ব দিক থেকে সূর্যের হালকা আলো আসছে। চাঁদটা এখনো পশ্চিম আকাশে মিশে যায়নি। ইতিমধ্যে আশেপাশে লোকের আনাগোনা লক্ষ্য করলো সিকন। ভোর হচ্ছে.. আশে পাশের কৃষকরা তাদের শীতকালীন সবজি বাজারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সিকনের আরো একটারাত অতিবাহিত হলো রাস্তার পাশে। সে জানে না আর কতরাত এমন রাস্তার পাশে বেঞ্চিতে শুয়ে বসে কাটাতে হবে। সে জানে না তার ভবঘোরে পরিস্থিতি কবে শেষ হবে। কবে পৌছাঁবে তার গন্তব্যে । আরো একটা দিন শুরুর সাথে সাথে আরো একটা রাতের অপেক্ষা শুরু তার …….
© অনিক ঘোষ
প্রথম মন্তব্য লিখুন
মন্তব্য লেখার জন্য আপনাকে অবশ্যই লগ ইন করতে হবে