গল্প পড়ার শখ আমার অনেক দিনের আর এই শখে পরেই এক দাদু বাড়িতে গিয়েছিলাম ঘুরতে। সে দাদুর নিজস্ব একটা পাঠাগার আছে। আর তার সবমিলিয়ে প্রায় দুই হাজারের উপর গল্পের বই, ডাইরি, খাতা আছে। তার মধ্যে একটি বেশ পুরানো খাতা তিনি আমাকে দেন পড়তে। আর আজকের গল্পটা সেই খাতা থেকেই নেওয়া । তাহলে গল্পটা শুরু করা যাক।
অক্টোবর মাস চলছে বার ও তারিখ কিছুই জানিনা। কিছুক্ষণ আগেই চোখ খুলেছে। হয়তো মাথায় ভিষণ আঘাত লেগেছিলো। চোখ খুলেই দেখলাম বালির উপর পরে আছি আর পাশে একটা ব্যাগ । অবশ্য অন্য কারোর ব্যাগ না, আমার নিজের ব্যাগই। ব্যাগে আমি আহামরি কিছু রাখিনি, রেখেছি শুধু একটা খাতা, কয়েকটা কলম আর কিছু টাকা। খাতা রাখার কারন আমি মাঝে মাঝে একটু লেখা লেখি করি। কোনো খবরের কাগজে বা বইয়ের জন্যে নয়। যেমন এখন লিখছি, ঠিক এইরকম। এমনিতে দুই- তিন লাইন করে লিখি কিন্তু এখন একটু বেশিই লিখছি । আশেপাশে কেউ নেই তো তাই।
::২::
মাথার ব্যাথাটা কমেছে। আর আমার কাছে এখন পরিষ্কার আমি এখানে কিভাবে এলাম। গত মাসে আমি সমুদ্র ভ্রমনে বের হয়েছিলাম। এ কথাটা গুছিয়ে সুন্দর করে বললাম। যদি সত্যিটা বলি তাহলে দাড়ায় আমি আমার দেশ ছেড়ে পালাচ্ছিলাম। একদম যে সব ঠিকঠাক করে, তা কিন্তু নয়। এমনি হুট করে। হাতের কাছে ব্যাগ ছিলো আর হাজার তিনেক টাকা। দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গেলেই ভালো ভাবে থাকতে পারবো ভেবেই বের হয়েছিলাম। আর সমুদ্রের কাছে এসে একটা মাঝিকে পাঁচশ টাকা দিয়ে রাজি করিয়েছিলাম যেকোনো একটা কার্গো শিপে যেনো আমাকে তুলে দেয়। যেই ভাবা সেই কাজ। সবার চোখে ফাকি দিয়ে মাঝি আমাকে একটা বড় শিপে তুলে দিলো। তাও আবার শিপের একটা কেবিনে যেখানে শিপের লোক আসে না বললেই চলে। কিন্তু দেখুন আমি এখন এই দ্বীপের মধ্যে আটকে পরলাম। এই দ্বীপে এসে পৌঁছানো কম রোমাঞ্চকর ছিলো না, যেনো কোনো ইংরেজি সিনেমা।
মাঝি তো আমাকে রেখেই উধাও হলো। এরপর আমি কেবিনটাতে ভালো ভাবে গুছিয়ে বসলাম। জাহাজ চলতে শুরু করল, জাহাজের ক্রমাগত দুলুনি আমার শরীরের বারটা বাজাচ্ছিলো। আর তখন কেবিনের দরজার সামনে কারো অস্তিত্ব লক্ষ্য করলাম। এক জন নয়, দুজন। দুজনে মিলে কেবিনটা খুলতে চেষ্টা করছে। আর কিছু ভেবে ওঠার আগেই কেবিনের দরজা খুলে গেলো। আমি দরজার সাথে পিঠ লাগিয়ে ছিলাম বলে তাদের সামনে হুমরি খেয়ে পরলাম। তারা দুজন-ই আমাকে দেখে এবং কিছুটা বিস্মিত হয়ে একটু সরে দাঁড়ায়। আমি তখনি উঠে দাঁড়াই এবং ভাবতে থাকি এখন কি করবো..? তাদের সাথে কথা বলবো ? না, দৌড়ে পালাবো? এর মধ্যেই একজন আমাকে ধরে ফেলে এবং আরেকজন জাহাজের আরো ভেতরে চলে যায়। যে ব্যক্তি আমাকে ধরে ছিলো সে অনেক শক্ত করে ধরেছিলো তাই আমি তার হাত থেকে ছুটে দৌরে পালাতে চেষ্টা করি। জাহাজের ছাদে পৌঁছে যাই এবং সেখান থেকে একটা লাইফ জ্যাকেট নিয়ে সমুদ্রের মধ্যে ঝাপ দিয়েছি, তখনি জাহাজের রেলিংএ মাথাটা সজোরে লাগে আর আমি সমুদ্রে পরি। এরপর যখন চোখ খুলে তখন দেখি আমি এখানে পরে আছি। যাই এখন একটু আশেপাশে দেখি কি আছে এখানে।
::৩::
অচেনা জায়গাতে যদি হঠাৎ চোখ খুলে যায় তাহলে আশে-পাশের প্রকৃতি বুঝতে অনেক সময় লাগে। এইতো আমি যখন বালির উপর পরেছিলাম তখন ভেবেছিলাম সকাল হয়েছে। কিন্তু এখন দিগন্তে সূর্যের মিলিয়ে যাওয়া দেখে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা। আমি অনেকটা সময় পার করেছি এই দ্বীপটাতে। অনেকটা সময় বললাম কারন আমার চোখ খোলার পর আমি যে আশেপাশে ঘুরছিলাম তখনি দেখি লতা আর বাঁশ দিয়ে তৈরি একটা ঘর আর ঘরের মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দের কলটা আর আমার খাতা কয়েকটা পৃষ্ঠা । কয়েকটা বলতে ছয়টা পৃষ্ঠা তার মধ্যে দুইটা পৃষ্ঠা একদমি খালি আর বাকি চারটার দুটোর লেখা বোঝা যায় না ঠিক মতো এবং বাকি দুটোতে আমি অনেক আগে লিখেছিলাম যা আমার স্পষ্ট মনে আছে। আর এতেই পরিষ্কার আমি এই দ্বীপে আজ আসিনি । বাঁশের ঘরটার পাশে একটা কলা গাছ আছে আর তাতে পাকা পাকা কলাও আছে। হয়তো কেউ আসে না এখানে, তাই কলাগুলো গাছেই পেকেছে। এতো ভেবে কি লাভ? আজ রাতে কলা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে পারবো ।
::৪::
এটা যদি খাতা না হয়ে ডাইরি হতো তাহলে অবশ্যই এখন আমি বুঝতে পারতাম আজ কত তারিখ এবং কি বার। একটু আগেই কলা খেয়েছি। ভেবেছিলাম অনেকগুলো কলা খেতে পারবো কিন্তু না। মাত্র চারটা কলাই খেতে পেরেছি । মাথার উপর এখন চাঁদ রয়েছে। আমি বাঁশের ঘরটা থেকে কিছুটা দূরে বসে আছি। জোছনার আলোয় সব দেখা যাচ্ছে। যে খাতাটায় লিখছি সেটা এবং অনেক দূরে থাকা বড় পাথরটা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। অবশ্য বাঁশের ঘরটা থেকে কিছু দূরে একটা কিছু মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে আবার হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাচ্ছে । হীরের মতো চকচক করছে, হীরে হতেই পারে। অবশ্য উঠে গিয়ে দেখে আসলেই হয়। যাই গিয়ে দেখেই আসি।
::৫::
যেটা দেখতে গিয়েছিলাম সেটা দেখে তো মন ভরেই গেছে সাথে একটা বাক্সও পেয়ে গেছি। হীরের মতো যেটা চকচক করছিলো সেটা আসলে শিশির কণা। গাছের পাতার প্রান্তে জমা হতো এবং যে বাক্সটা পেয়েছি সেটার উপরে লাগানো আয়না থেকে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে শিশির কণায় আসতো। আর এতেই একটা বড় বিভ্রমের তৈরি করেছিলো। অবশ্য দেখতে গিয়ে লাভি হয়েছে । সখও মিটলো আর একটা বাক্সও পেলাম। একেই বোধয় বলে "রথ দেখাও হলো, কলা বিক্রিও হলো "। বাক্সটা দেখতে ততটা আহামরি নয়। কাঠের বাক্স, ঢাকনার দিকে উপরে এক খন্ড আয়না লাগানো। বাক্সের সামনে কিছু লেখা আছে যেগুলো মুছে গেছে বলাই যায়। বাক্সটা না খুলে থাকতে পারছি না।
::৬::
বাক্সটা খোলার পর প্রথমেই চোখে পড়লো আমার চির-পরিচিত কৃষ্ণচূড়া ফুল। শুকনো বলে ফুলটা দেখে একটু কেমন জেনো লেগেছিলো। এরপর যেটা পেলাম বাক্সটার মধ্যে তা হলো একটা ১৯৩১ সালের চামড়ায় মোড়ানো ডাইরি। ডাইরির সাথে একটা সুন্দর ঝর্ণা কলমও ছিলো। অবশ্য সেটার কালি শুকিয়ে গেছে। বাক্সটার মধ্যে একটা ছোট সিগারেটের বাক্সও ছিলো এবং তাতে এক বাক্স দেশলাই আর একটা আধ খাওয়া সিগারেট। আর পুড়ানো ধাচের একটা রিভালভার, যেটা একদমি নষ্ট। বাক্সটা যার ছিলো সে খুব সৌখিন লোক হবেন হয়তো।
::৭::
মনের সাথে অনেক্ষন যুদ্ধ করার পর বাক্সে পাওয়া সেই ডাইরিটা পড়েই ফেললাম। পড়ার পর বুঝলাম ডাইরিতে সুধু একটা মেয়েকে নিয়েই লেখা হয়েছে। ডাইরির লেখক যেভাবে লিখেছে সে ভাবে উল্লেখ করছি " মানুষ সব সময় বেশি বেশি চায়। কিছুতেই মন ভরে না। যেমন আমি, এত সুন্দর চাঁদের আলোর মধ্যে বসে আছি কিন্তু তবুও মনে হচ্ছে যদি আশেপাশের পরিবেশটা আরো একটু সুন্দর হতো। আমার পাশে এখন চঞ্চলা বসে আছে। সমুদ্রের থেকে মাঝে মাঝে আসা দমকা বাতাসে তার চুল দোলছে। চঞ্চলার চুল সহজে বাতাসে দোলখায় না। বাতাসে দোলার মতো তার চুল নয়। তার চুল অনেক বড়বড় এবং অনেক ঘনও বটে। বিনুনি করলে অনেক মোটা বিনুনি হয়।
সে পাশে বসে থাকলেও আমার সাথে কথা বলছে না। একটু আগে সামান্য কথা নিয়ে ঝগড়া হয়েছে আমাদের। চঞ্চলার সাথে আমার গতকাল রাতেই প্রথম দেখা হয়েছে আর এর মধ্যেই আমরা কত ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছি। তার আসাটা ছিলো একটা স্বপ্নের মতো। চাঁদের আলোয় এক নারী যেনো আবেগ-ভরা চোখে আমার দিকে আসছে । অচেনা হলেও যেনো মনে হচ্ছে অনেক দিনের চেনা। তার ঘন কালো চুল কোমর পেরিয়ে যেনো মাটি ছুঁচ্ছে। সাথে মাথায় থাকা ডানদিকে একটু হেলানো কৃষ্ণচূড়া ফুলের চূড়া, একেবারে যেনো অপূর্ব একটা দৃশ্য তৈরি করেছিলো। সে আমার সামনে এসেই প্রথমেই বললো 'এই যে,আমি চঞ্চলা । আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো ' । চোখ ভরা বিস্ময় আমি আমার নাম বললাম। আমিতো প্রথমে ভেবেছিলাম এটা আমার কল্পনা। তা ভাবারো যুক্তি যুক্ত কারন আমার কাছে আছে। দশ বারো দিনে কারো দেখা পাইনি আজ হঠাৎ করে এই সুন্দিরী রমনির সাথে দেখা। সুধু দেখা যে তাও নয় কথোপকথন। সে গতকাল থেকেই আমার সাথে আছে। কথায় কথায় একবার বলেছিলো তার কিছু ছেলে লাগবে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমাকে দিয়ে হবে কিনা। সে এর উত্তরে আমাকে বলল শুধু তোমাকে দিয়ে হবে না।
চঞ্চলা কখন যে পাশ থেকে উঠে গেছে খেয়ালি করিনি। এখন খেয়াল করলাম যখন তার হাতে থাকা বড় তরবারিটার থেকে আলো এসে আমার চোখে পড়লো। আচ্ছা তার হাতে বড় তরবারি কেনো? এখানে আসলে জিজ্ঞাসা করতে হবে। তার হাতের তরবারি সাথে মাথায় থাকা কৃষ্ণচূড়া ফুলের চূড়োটা সুন্দর মানিয়েছে। " এই পর্যন্তই ডাইরিটাতে লেখা। শেষ পর্যন্ত জানার অনেক আগ্রহ হয়েছে কিন্তু কি করার ডাইরির বাকি পৃষ্ঠাগুলো খালি। যাই অনেক রাত হয়েছে ঘুমোতে হবে।
::৮::
সূর্যাস্ত দেখছি আর সারাদিনের কথা ভাবছি। বিশেষ করে দুপুরে ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা। অন্ধকার নামার সাথে সাথে মানুষের ভয় বেড়ে যায় কিন্তু আমার বেলায় এর উল্টো হচ্ছে ক্রমেই দুপুরে পাওয়া ভয় দূরে চলে যাচ্ছে।দুপুরে একটু ভয় পেয়ে ছিলাম। ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। আজ দুপুরে যখন ঘুরতে বের হয়েছিলাম তখন আমি অনেক গুলো বাক্স দেখতে পাই এবং সেগুলোর ভিতর কি আছে সেটা দেখতে যাই। প্রতিটা বাক্সের মধ্যেই আমি আলাদা আলাদা মানুষের ব্যবহৃত বস্তু দেখি। যেনো জায়গাটা একটা কবরস্থান। কিছু কিছু বাক্স অনেক পুড়াতন আবার কোনটা প্রায় নতুন। বাক্স দেখতে দেখতে একটা গর্তে পরে যাই যেটাতে কয়েক হাজার এরকম বাক্স আছে। এতগুলো বাক্স একসাথে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে যাই এবং গর্ত থেকে দ্রুত বের হয়ে আসি। সারাদিন এটা নিয়ে ভেবেছি।
চাঁদটা আজকে একটু বেশিই বড় দেখাচ্ছে। জোছনায় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সমুদ্র তীর বরাবর কে যেনো হাটছে। হেটে হেটে এদিকেই আসছে। দেখেতো কোনো মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। মাথায় ঘন কালো চুলে একটি চূড়ো পড়া। দেখতে দেখতে আমার কাছেই চলে এসেছে।
খাতাটাতে এতটুকুই লেখা আছে। হয়তো এর পরে এমন হয়েছে।
“কিছু বুঝে উঠার আগেই সে বলে উঠলো
এই যে, আমি চঞ্চলা। আপনাকে এখানে দেখে ভালো লাগলো ।।”
প্রথম মন্তব্য লিখুন
মন্তব্য লেখার জন্য আপনাকে অবশ্যই লগ ইন করতে হবে