প্রিয় জয়ন্ত স্যার


প্রিয় জয়ন্ত স্যার

তখন সবে হাইস্কুলে উঠেছি।মনের মধ্যে একটা বড় হয়ে গেছি ভাব।এখন আমি হাইস্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ি কত বড় ব্যাপার—আমার কাছে এসবই মনে হতো।

কিন্তু এই বড় ব্যাপারের মধ্যে ভয়ের একটা ব্যাপার ঢুকে গেছিল!—যখন বন্ধুবান্ধব আর চারপাশের মানুষের কাছ থেকে শুনতে পেলাম এই স্কুলে একজন কড়া স্যার আছেন,খুব কড়া!তখনও এত ভয় পাইনি,ভয় পেয়েছিলাম যখন জানতে পারলাম যে,এই কড়া স্যারই নাকি ক্লাস সিক্সের ক্লাস টিচার আর প্রথম ক্লাসই উনার।চারপাশে উনার এত সুনাম শুনছিলাম, ভয় তো পাওয়ারই কথা!এই স্যারের নাম জয়ন্ত স্যার।যদিও আমি তখন ঐ স্কুলের কোনো স্যারকে ভালোভাবে চিনতাম না!

প্রথম ক্লাস, স্যার ক্লাসে ঢোকার পর সব নিরব।সেদিন স্যারকে প্রথম দেখেছিলাম।স্যার ছিলেন একদম ছিমছাম ধরনের,বয়স ৩৫-৪০এর মধ্যে।মাথায় হালকা টাক।কিন্তু স্যার সেদিন কি পড়েছিলেন,তা খেয়াল নেই!তবে স্যার বেশিরভাগসময়ই লম্বা হাতা শার্ট আর ঢিলেঢালা জিন্স বা নরমাল প্যান্ট পড়তেন।অনেকসময় শার্টের উপরে কোর্ট পড়তেন।

আমার মনের ভিতের ঢোল বাজছিল ভয়ে!

কিন্তু স্যার এতসুন্দর করে প্রথমক্লাসটা নিলেন—আমাদের পরিচয় জানলেন,কি হতে চাই বড় হয়ে এসব জানলেন আর নিজের পরিচয় দিলেন।যদিও স্যারের চেহারায় কড়াভাব স্যার ফুটিয়ে রেখেছিলেন কিন্তু ক্লাস করেছিলেন অনেক আনন্দ করে।উনার প্রথম ক্লাসটা আমার খুব ভালো লাগলো,যদিও ভয় কাটেনি।তবে তখন আমার মনে হয়েছিল ঠিকই যে,স্যারকে দেখে অনেক ভালো লাগলো,ক্লাসও নেন মজা করে, পড়ানও অনেক ভালো—এমন স্যারকে ভয় পাবো কেন?কিন্তু ভয় কি সহজে যায়?

উল্টো কয়েকদিন পরে ভয় আরও বেড়ে গেলো!স্যারের চেহারায় সবসময় একটা কড়া-কড়া ভাব ফুটিয়ে রাখতেন—যদিও এই কয়দিনে আমরা স্যারের এই চেহারায় অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম।ভয়টা বাড়লো অন্য এক কারণে—

স্যারের ক্লাসে পড়া না বুঝলে, স্যার আবার বুঝিয়ে দিতেন কিন্তু যদি ক্লাসে মনোযোগী না হয়ে দুষ্টুমি ও হট্টগোল কেউ করে আর যদি কেউ বাসার কাজ ঠিকমতো না করে, তখন বোঝা যায় স্যারের আসল রাগ!যে এসব করতো,ওকে দাঁড়া করিয়ে স্যারের রাগ ওর উপরে ঝেড়ে দিতেন—বকতেন না বেশি, চোখ লাল করে যেভাবে তাকাতেন তখনই মনে হতো ভয়ে প্রাণটা বুঝি এখনই চলে যায়! আর ক্লাসের সবাইকে একসঙ্গে ধমক দিতে হলে স্যার হঠাৎ করে উঁচু গলায় গম্ভীর হয়ে —"এইক…" বলে ধমক দিতেন!তখন সবাই শান্ত!আর নির্দিষ্ট কোনো দুষ্টু ছাত্রকে বলতেন,"তোর কানটা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।"

 স্যার মারতেন বেত দিয়ে কিংবা হাত দিয়ে বিশেষ বিশেষ জায়গায়!কখনো হাত বা পায়ে, আবার পিছনেও মারতেন।স্যার এমনভাবে মারবার অভিনয় করতেন যে, রক্ত হিম হয়ে যেতো ভয়ে! 

অবশ্য কেউ যদি স্যারকে বাসার কাজ না করার কোনো যুক্তিসংগত কারণ দিতে পারতো, তখন স্যার তাকে ছেড়ে দিতেন।

অভিজ্ঞতায় জানতে ও বুঝতে পারলাম,স্যারের মারে তেমন ব্যথা পাওয়া যেতো না!স্যার এমনভাবে মারবার অভিনয় করতেন যেন অন্যরা দেখে ভয় পেয়ে ক্লাসে মনোযোগী থাকে এবং বাসার কাজ ঠিকমতো করে।তখন স্যার না মারলেও স্যারের লাল চোখ আর কড়াভাব দেখে ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যেতো!

শাস্তির পালা শেষ হলে সুন্দর করে ক্লাস করতেন।তখন এত ভয় লাগতো না তবে ক্লাসে সবাই মনোযোগী থাকতো —এটাই স্যারের ম্যাজিক!

স্যার যাকে মারতেন,সে তখন মারে ব্যথা না পেলেও স্যারের কড়া মুখমন্ডল দেখে, মারে যে ব্যথা পাওয়া যায় না —এটাই বেমালুম ভুলে যেতো!

যদিও আমি কখনো স্যারের মার খাইনি।তবে অন্যদের বিবরণে শুনেছি।

জয়ন্ত স্যার ছিলেন অত্যন্ত ভালো একজন মানুষ।

সিক্সে পড়াকালীন আমি প্রায়ই অসুস্থ থাকতাম!যদিও অসুস্থতা আমার আরও আগে থেকেই ছিল—ক্লাস ফোর থেকে! যাইহোক, স্যার আমার অসুস্থতার কথা জানতেন।বাবা উনাকে সব বলেছিলেন।কারণ,আমি বেশিরভাগ সময় স্কুলে হয়তো যেতে পারবো না বলেই আগে থেকেই স্যারকে বলে রেখেছিলেন।আমি অনেকসময়ই স্কুলে যেতে পারতাম না,অনেকসময় দরখাস্ত দিতাম, অনেকসময় দিতাম না—স্যারকে শুধু বলতাম।স্যার আমাকে কোনোসময় কিছু বলেননি,এমনকি বকেননিও।অন্য স্যার হলে হয়তো একটু হলেও বকতেন—এতদিন অনুপস্থিতি থাকার জন্যে!হয়তো বলতেন,"এত অসুস্থ থাকলে আর পড়া লাগবে না!এত অসুস্থতা কিসের?"

আবার আমি অনেকসময় টিফিন পিরিয়ডেও স্যারের কাছ থেকে ছুটি নিতাম।অনেকদিন দরখাস্ত লিখে,অনেকদিন দরখাস্ত ছাড়া—স্যারকে বলে।স্যার কিছু না বলে ছুটি দিয়ে দিতেন।শুধু জিজ্ঞেস করতেন,"শরীরটা খারাপ লাগছে?" তার পরমুহূর্তেই বলতেন, "ঠিক আছে, যাও।"

আমি প্রথম প্রথম যদিও ভয় পেতাম, স্যারের কাছ থেকে এত ছুটি নিতে।কিন্তু ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম।তাই বলে কিন্তু আমি এর কোনো সুযোগ উঠাইনি, শুধু শুধু স্কুল ফাঁকি দিয়ে! আমি যেদিন অসুস্থ থাকতাম, সেদিনই স্কুলে আসতাম না বা টিফিন পিরিয়ডে ছুটি নিতাম।

আমার একটা ঘটনা খুব মনে পড়ছে—

সিক্সে পরীক্ষা দিয়ে সেভেনে উঠেছি।স্কুলে বই আনতে গেছি—

স্যার আমিসহ আরও ছাত্রকে বই যেখানে রাখা হয়,সেখানে নিয়ে গিয়ে বই দিয়ে দেন।সব ছাত্ররা বই নিয়ে চলে গেছিল। শুধু ছিলাম আমি,আমার আরেকটা বন্ধু উদয় আর জয়ন্ত স্যার।স্যার চায়ছিলেন, কিছু বই নিয়ে স্যারের রুমে রেখে দিতে,যাতে ওখান থেকেই কিছু ছাত্রকে বই দিয়ে দিতে পারেন।তাই স্যার অনেকগুলো বই বের করলেন।বেশিরভাগ বই নিলেন স্যারই আর কিছু বই নিলো উদয়।আর কিছু ছিল,খুব কম কিছুই।আমি ওগুলো নিতে গেলে স্যার বললেন,"তুমি পারবে না,তুমি অসুস্থ। তুমি রেখে দাও।"

আমি বললাম, " পারবো স্যার। কিছু হবে না।"

স্বরটা নরম করে বললেন,"পারবে তো।আচ্ছা, ঠিক আছে। আস্তে আস্তে নিয়ে আসো তোমরা।নিয়ে আমার রুমে আমার টেবিলের পাশে নিচে রেখে দাও।"

আমার অসুস্থতার কথা স্যার তখনও মনে রেখেছিলেন!

আমার বড়দাও এই স্কুলের ভালো একজন ছাত্র ছিলো,আমিও স্কুলে নিয়মিত না আসলেও পড়ালেখায় ভালো ছিলাম,দুষ্টুমিও করতাম না বেশি আর অসুস্থ তো ছিলামই—এজন্যই হয়তো স্যার আমাকে কখনোই মারেননি।স্যার আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। 

জয়ন্ত স্যার কিন্তু অনেক দায়িত্ববান একজন মানুষও ছিলেন।স্কুলের অনেক অনুষ্ঠানের দায়িত্ব স্যার নিতেন।অনুষ্ঠান একেবারে সুসম্পন্ন করে তবেই নিশ্চিন্ত হতেন।বিশেষ করে প্রতিবছর সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব স্যার একা নিতেন।অন্য স্যাররা এসব ঝামেলায় থাকতে চায়তেন না!কিন্তু জয়ন্ত স্যার সবসময় এগিয়ে থাকতেন। সুন্দর করে পুজোর সুসম্পন্ন আয়োজন করে  দায়িত্ব পালনও করতেন।যদিও ছাত্ররাও স্যারকে সাহায্য করতো।কিন্তু বেশিরভাগ কিছু স্যারই করতেন।ছাত্রদেরকে স্যার কিছু দিকনির্দেশনা দিতেন,কিছু কাজের।ছাত্ররা সেগুলো করতো।যেমন সাজানো-গোছানো ছাত্ররাই করতো।আর মাঝেমাঝে অন্য কাজেও স্যারকে সাহায্য করতো। বাকিসব স্যার সামলে নিতেন।স্যার থাকতে ছাত্রদের কোনো চিন্তার কারণই ছিল না।প্রতিমা,পুজোর আয়োজন,পুজোর বাজার,প্রসাদ, পুরোহিত বায়না,ঢাক  থেকে শুরু করে সব স্যার করে নিতেন।প্রতিবছরই খুব সুন্দর করে স্যারের দায়িত্বে সরস্বতী পুজো হতো স্কুলে।


স্যারের আরেকটা গুণের কথা না বললেই নয়!সেটা হলো স্যারের —স্পিড!আসলে স্যার চলাফেরা করেন খুব দ্রুতভাবে!বিশেষ করে পরীক্ষার হলে স্যারের স্পিডের নমুনা দেখা যেতো।স্যার প্রশ্নপত্র এবং খাতা এত স্পিডে সবাইকে দিতে শুরু করতেন যে,একের পর এক দিয়েই যেতেন যেন সব প্রশ্নপত্র বা খাতা ছিঁড়েই যাচ্ছে! যদিও ছিঁড়তো না—স্যার টেকনিক করেই এত স্পিডে দিতেন!এমনকি অন্য স্যারদের থেকে স্যারের আরেক গুণের কথাও শুনেছি যে, স্যার নাকি পরীক্ষার খাতা দেখার সময় স্পিডে একের পর এক খাতায় সাইন দিতে গিয়ে অনেক খাতাই ছিঁড়ে ফেলতেন!

স্যার গ্রামার আর হিন্দুধর্ম ক্লাস নিতেন।স্যারের ক্লাসে একটু ভয় লাগলেও কখনো ক্লাস বোরিং লাগেনি।সবসময় ভালো লাগতো ক্লাস করতে।

স্যারের ক্লাসের আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ হলো—স্যারের আদালত! সপ্তাহে এক বা দুইদিন স্যার ক্লাসে আদালত বসাতেন,ওখানে ছাত্রদের পুরো সপ্তাহের দুষ্টুমির বিচার করতেন!ওই আদালতে স্যার ছিলেন বিচারক।আর কয়েকজন ছাত্রকে স্যার বছরের শুরুতেই উকিল বানিয়েছিলেন!আর কজনকে বানিয়েছিলেন পুলিশ-কনস্টেবল!আর জেল ছিল ক্লাসরুমের শেষের কোণায় কিছু জায়গাজুড়ে!ওখানে কিছু ছাত্র মানে যারা পুলিশ-কনস্টেবল তারা আসামিকে ধরে চারদিক থেকে ঘিরে রাখতো—ওটাই ছিল স্যারের জেল!আর স্বাক্ষী হতো আদালতে বিচারের সময়,যারা অভিযোগী দুষ্টু ছাত্রকে দুষ্টুমি করতে দেখেছে তারাই স্বাক্ষী! আর ক্লাসের বাকি ছাত্ররা স্যারের এই মজার আদালতের বিচার উপভোগ করতো!

ওইদিন স্যারের কাছে দুষ্টু ছাত্রদের নামে নালিশ দেওয়া হতো।স্যার ওই ছাত্রদের ক্লাসের মাঝখানে ডাকতেন!কখনো যাকে পুলিশ বানিয়েছেন তাকে বলতেন—"এই ওকে ধরে নিয়ে আয়!"—অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে! 

তারপর তাদের কথা শুনতেন,তারপর স্যার যার সাথে দুষ্টুমি করেছে এবং যে দুষ্টুমি করেছে তাদের দুজনকেই উকিল বেছে নেওয়ার সুযোগ দিতেন!তারা তাদের উকিল বেছে নিতো!বেছে নেওয়ার পর স্যারের কাছে তাদের নাম বলা হতো!যেমন কোনো উকিল ছাত্রের নাম —দিব্যজিৎ রায়।স্যার বেশ গম্ভীরভাবে বিচারকের মতো গলায় বলতেন,"অভিযোগীর পক্ষে কেস লড়বেন, দিব্যজিৎ রায়…আপনি শুরু করতে পারেন…!"

তারপর স্যার দু'পক্ষের উকিলের বক্তব্যই শুনতেন!কখনো অভিযোগীকেও প্রশ্ন করতেন!কখনো বাদিকেও করতেন।তারপর স্বাক্ষী হাজির করা হতো!আরে হ্যাঁ,বিচারকের পিছনে একজন লোক থাকে না,যিনি লোককে নাম ডেকে হাজির হতে বলেন?ওরকমও কাউকে বানিয়েছিলেন বোধহয় স্যার—ঠিক মনে পড়ছে না!

সব শুনে-টুনে স্যার তার রায় শুনাতেন!কোনো ছাত্রকে কান ধরে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি দিতেন,তো কাউকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উঠ-বস করার শাস্তি দিতেন!কাউকে অন্য শাস্তি দিতেন! —এ-সবই 

অন্যায়ের পরিমাণের উপর নির্ভর করতো।বেশি দোষ করলে স্যার জেলে রাখতেন!এই ১০-১৫ মিনিটের মতো কিংবা অতিরিক্ত হলে ক্লাসের শেষ পর্যন্ত! বলতেন এভাবে," অভিযুক্তের দোষ প্রমাণ হয়েছে, তাকে ১০ মিনিটের কারাদণ্ড প্রদান করা হলো!...অফিসার নিয়ে যান…! "

আমরা বসে-বসে এসব উপভোগ করতাম,হাসতামও তবে বেশি জোরে না!—এসব আমাদের কাছে একধরনের বিনোদনই তো ছিল!

আমার বড়দার কাছ থেকে শুনেছি,তাদের সময়ে নাকি স্যার কখনো দুটাকা করে জরিমানাও করতেন!এই টাকার দায়িত্ব আমার বড়দার কাছেই থাকতো।একবার নাকি দুটাকার নোটের বাণ্ডিল হয়ে গেছিলো!এই টাকা দিয়ে স্যার ভালো ছাত্রদের পুরস্কার দিতেন!

এমনই ছিলেন আমাদের প্রিয় জয়ন্ত স্যার,এমনই ছিল তার আদালত আর এমনই ছিল তার শাস্তি!তার শাস্তির কারণে কেউ ব্যথা পায়নি,আনন্দ পেয়েছে —তবে ভালো হয়েছে ঠিকই!

স্যার আবার মাঝে-মধ্যে  ক্লাসের শেষে ছাত্রদেরকে দিয়ে কবিতা আবৃত্তি করাতেন,গানও গাওয়াতেন আবার অভিনয়ও করাতেন টুকিটাকি! স্যারের ক্লাস তো ভালো লাগতোই—পড়ার পরে এরকম বিনোদন!তবে সবসময় ক্লাসের পর সময় পাওয়া যেতো না,ফলে সবসময় হতো না!তবে মাঝে-মধ্যে হতোই!

স্যার ধর্ম ক্লাসে আবার বিভিন্ন শ্লোক আবৃত্তি করাতেন কিংবা নিজেই পড়ে বুঝিয়ে দিতেন।

স্যার যদিও গম্ভীর হয়ে থাকতেন, তবে মনে মনে রসিক এবং মজার মানুষ ছিলেন তিনি—তার ক্লাস নেওয়া,তার শাস্তি এসব থেকেই তো বোঝা যায়! 

তাই স্যারকে আমি একটি পদবি দিয়েছি—"গম্ভীরতায় রসিক মানুষ "—স্যারকে তো বলিনি,এই পদবির কথা! আমিই মনে মনে দিয়ে দিলাম এই পদবি!

এমন স্যারের জীবনেও দুঃখ ছিল ঠিকই, স্যারের অনেক ঋন ছিল!আরও হয়তো কিছু পারিবারিক সমস্যা!—লোকমুখে জানা,তবে সত্যিই ছিল!তবে তার ফলে তার মজার টিচিং থেমে থাকেনি!স্যারকে দেখলে বোঝাই যেতো না, স্যারের যে কত দুঃখ! 



 

অনেকদিন যাবত স্কুল বন্ধ ছিল,শুধু এদেশে না —সারাবিশ্বেই!লকডাউন ছিল সবখানে!

তারমধ্যেই আমাদের প্রধান শিক্ষক স্যার মারা গিয়েছিলেন!আবার তার মধ্যেই শুনেছিলাম,জয়ন্ত স্যার নাকি আমাদের স্কুল ছেড়ে চলে যাবেন!প্রথমে কষ্ট পেয়েছিলাম,তবে বিশ্বাস করিনি—মনে করেছিলাম মিথ্যে কথা ছড়াচ্ছে! কিন্তু আবার পরপর অনেকবার শুনেছিলাম কথাটা!কিন্তু কেন ছেড়ে চলে যাবেন—তা জানতাম না!

পরে আমার বড়দা তার জুনিয়র থেকে জানতে পেরেছে, স্যার সত্যিই চলে যাবেন!আমাদের স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার স্যার হয়েছিলেন তখন হেডমাস্টার! বেশি সুবিধের লোক ছিলেন না! তার সাথে নাকি জয়ন্ত স্যারের কোনো এক সমস্যা হয়েছিল!আর কিছু সমস্যা হয়েছিল অন্য স্যারদের সাথে! সব কথা লিখছি না,তবে আমার জানামতে জয়ন্ত স্যারের কোনো দোষ ছিল না!

স্যারের যাওয়ার কথায় খুব কষ্ট হয়েছিল! 


কিন্তু লকডাউনের পর স্কুলে প্রথম সরস্বতী পুজোয় স্যারকে দেখে মনে হয়েছিল,হয়তো স্যার যাবেন না!খুব খুশি হয়েছিলাম।স্যারকে দেখলাম,আগের মতোই দৌড়োদৌড়ি করে পুজোর সব দায়িত্ব রক্ষা করছেন।কখনো দেখি স্যারকে পুজোর জায়গায় পুরোহিতকে ফুল-বেলপাতা এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করছেন,কখনো খিচুড়ি রান্না যেখানে হচ্ছিল, সেখানে পাকশীকে কেটে-কুটে দিয়ে সাহায্য করছেন! কখনো কোনো জিনিসের দরকার পড়ছে, স্যার গিয়ে নিয়ে আসছেন বাজার থেকে!কখনো প্রসাদ দিচ্ছেন! পুজোটা খুব মজা হয়েছিল! 

কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল,এই পুজোয় ছিল স্যারের দায়িত্বে স্কুলে হওয়া শেষ পুজো!

স্যার চলে গেলেন অন্য এক স্কুলে,আমাদের শহর থেকে অনেক দূরের এক শহরের স্কুলে! —এসব অন্য স্যার আর লোকমুখে শুনেছিলাম। 

ওই সরস্বতীর পুজোর পর স্যারকে আমি বোধহয় একবার দেখেছিলাম,তারপর আর দেখিনি—আজ পর্যন্ত!একবছরের উপর হলো।আমি নাইনে প্রথম উঠার পরই স্যার চলে গিয়েছিলেন,এখন আমি টেনে পড়ি!

স্যারকে এবং স্যারের ক্লাসকে, স্যারের আদালতকে,স্যারের শাস্তিকে, স্যারের গম্ভীরতাকে খুব মিস করি।

আমার খুব কষ্ট হয় একথা ভেবে যে,আমাদের পরের ছাত্ররা এমন একজন স্যারের ক্লাস পাবে না!একথা ভেবেও কষ্ট হয় যে,এমন একজন স্যারকে আমরা সুসম্মানে বিদায়ও জানাতে পারিনি!

আমি কখনো জয়ন্ত স্যারকে ভুলতে পারবো না,স্যারকে সবসময় আমার মনে থাকবে।আমি এখন পর্যন্ত জয়ন্ত স্যারের মতো কোনো স্যারকে পায়নি—অবশ্য এমন স্যার কজনইবা হতে পারেন?তিনি এত কড়া হয়েও সব ছাত্রদের মন জয় করে নিয়েছেন! স্যারের পড়ানোর ধরণই ছিল অন্যরকম।ছাত্রদের সাথে তার সম্পর্কই ছিল অন্যরকম,কড়া এবং গম্ভীর তবে মজার, তবে রসিকতার এবং স্নেহের—এমন কজন স্যারই হতে পারেন?

স্যার যেখানেই থাকেন যেন ভালো থাকেন।

স্যারকে এখনও মনে করি,স্যারের ক্লাস,শাস্তি,আদালত,পড়ানো,গম্ভীরতা এবং অবশ্যই স্যারের হঠাৎ করে উঁচু গলায় গম্ভীরভাবে "এইক…" বলে ধমককেও মনে করি!—এসব কি কখনো ভুলতে পারি?

জয়ন্ত স্যার হয়তো নিজেও জানেন না,তিনি আমার এবং আমাদের সবার কতখানি প্রিয়—আমাদের প্রিয় জয়ন্ত স্যার!



~অনিক বিশ্বাস /১০.১.২৩

 

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে…)

~প্রিয় জয়ন্ত স্যারকে উৎসর্গ…


Nipendra Biswas
সিকন
তারা এই গল্পটি পছন্দ করেছেন ।

১টি মন্তব্য

Nipendra Biswas

Nipendra Biswas

এক বছর আগে

অত্যন্ত ভালো লাগলো🙂


মন্তব্য লেখার জন্য আপনাকে অবশ্যই লগ ইন করতে হবে


আপনার জন্য

নীল দ্বীপ (পর্ব৩)

নীল দ্বীপ (পর্ব৩)

নীল দ্বীপ পর্ব ৩ মৃন্ময় ...

তুমি অনন্যা  (পর্ব ৫)

তুমি অনন্যা (পর্ব ৫)

রনি বললো," একটা কবিতা বল...

কিছু করার নেই

কিছু করার নেই

 ১.আজকালকার দিনে চাকরি প...

অনুকথন

অনুকথন

অন্নদার ডাক নাম অনু।অনুর...

নীল দ্বীপ (শেষ পর্ব)

নীল দ্বীপ (শেষ পর্ব)

মৃন্ময়ের বিয়ের সবকিছু ঠি...

দার্শনিক ফল্টুদা

দার্শনিক ফল্টুদা

দার্শনিক ফল্টুদা —ফল্টুদ...

অদ্ভুত-উদ্ভট

অদ্ভুত-উদ্ভট

এ কোথায় এলাম আমি?হঠাৎ দে...

"রহস্যময়ী সেই ফোন কল"

"রহস্যময়ী সেই ফোন কল"

রাত ১০ টা বেজে ৩০ মিনিট ...

রিক্সাচালক

রিক্সাচালক

প্রখর রোদে দাড়িয়ে আছে আয়...

দৃষ্টিগোচর

দৃষ্টিগোচর

জীবনে অসফল এক ব্যাক্তি আ...

চিরকুট

চিরকুট

  এই গল্পটা আমার না।এটা ...

নীল দ্বীপ (পর্ব ৬)

নীল দ্বীপ (পর্ব ৬)

পরদিন সকালে শুভ্র আর মৃন...

প্রিয় মা

প্রিয় মা

  প্রিয় মা,কেমন আছো তুমি...

ফল্টুদার পরিচয়পর্ব

ফল্টুদার পরিচয়পর্ব

১.ফল্টুদার নামের ইতিকথা—...

ছোট দাদুর বাড়িতে কয়েকদিন.....(পর্ব ১)

ছোট দাদুর বাড়িতে কয়েকদিন.....(পর্ব ১)

ছোট দাদুর  বাড়িতে কয়েকদি...

পথশিশু

পথশিশু

লাবণ্য,  একজন পথশিশু। পথ...

নীল দ্বীপ (পর্ব ৫)

নীল দ্বীপ (পর্ব ৫)

মৃন্ময় খেয়াল করে দেখল শু...

আসক্ত

আসক্ত

১. আমি ভিডিওগেম আসক্ত। এ...

অ্যাক্সিডেন্ট

অ্যাক্সিডেন্ট

অ্যাক্সিডেন্ট আজ আমি ভীষ...

বটমূল

বটমূল

ছুটির ঘন্টা পড়ে গেল.......