সুবিমলবাবুর স্মরণীয় বাস জার্নি


সুবিমলবাবুর স্মরণীয় বাস জার্নি

১.

সুবিমলবাবু অনেকদিন পর আজ কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন। 

এমনিতে তো তিনি কোথাও গেলে নিজের প্রাইভেটকারেই যান, কিন্তু এবার তিনি ভাবলেন প্রাইভেট কারে যাবেন না। বাস বা ট্রেনে যাবেন। কিন্তু তিনি ট্রেনের কোন টিকিট পেলেন না, তাই বাসেই যাবেন। 

সুবিমলবাবু তো এমনিতে ভিড় পছন্দ করেন না। কিন্তু এবার কি মনে করে যে বাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন—একমাত্র তিনিই জানেন। 

স্টেশনে যা ভিড়,ভাবতেই পারেননি তিনি।

অবশেষে বাসে উঠে সিট খোঁজে নিয়ে বসলেন,সিটটা দেখে তো মনে হয় একজনেরই,কিন্তু ওতে বোধহয় দুজন বসা লাগবে!বাসের সিটগুলো এমন কেন হয় তিনি কিছুতেই বুঝতে পারেন না।এজন্যেই তিনি বাসে কখনো যান না, আজ সিদ্ধান্ত নিয়ে বোধহয় ভুলই করেছেন!কি আর করা?

এমনিতেই এই গরমে স্টেশনে দাঁড়িয়ে-বসে থাকতে থাকতে টাক যেন ফেটে গেছে!আর শার্ট তো ঘামে ভিজে একাকার! মাথাটাও কেমন ঝিমঝিম করছে।তারওপর আবার একজনের সিটে দুজন বসা—ভাবতেই পারছেন না তিনি।

তাও তিনি একটু শান্ত। কারণ, ওই সিটের লোকটা এখনো আসেনি। হয়তো শেষপর্যন্ত নাও আসতে পারে,তখন তিনি একাই বসে যেতে পারবেন।

দেখতে দেখতে বাসটা লোকে গিজগিজ করছে!কিন্তু এখনো ওই লোকটা আসেনি।সুবিমলবাবু বেশ খুশি,বাসটা এক্ষুণি ছাড়বে—লোকটার খোঁজ নেই।বোধহয় আর আসবে না,সুবিমলবাবু বেশ একটু প্রশান্তি অনুভব করলেন।

হঠাৎ একটা চ্যাংড়ামতো ছেলে বাসে উঠলো।বয়স ছাব্বিশের কাছাকাছিই হবে বোধহয়।চুলগুলো ঘাড় পযর্ন্ত লম্বা।চুলের জন্য কানও দেখা যায় না!চোখে কালো চশমা পড়ে আছে।এই গরমে পড়েছে অনেকগুলো চেইনলাগানো কালো প্যান্ট আর কালো লম্বাহাতা শার্ট! আর পড়েছে লেইসওয়ালা কালো কেডস!কাঁধে আবার ব্যাগ।

"এর মাথাটাথা ঠিক আছে তো!" ওকে দেখেই সুবিমলবাবুর মাথায় প্রথম প্রশ্ন জাগলো।

আর সাথে সাথেই ছেলেটা সুবিমলবাবুর পাশে এসে বললো,"এই যে আঙ্কেল,চেপে যান তো।"

"মানে?"

"আরেহ্,এটা আমার সিট।আপনি ওই পাশে যান।"

সুবিমলবাবু কিছু না বলে চেপে গেলেন।হতাশ হয়ে গেলেন,সিট তাহলে পূর্ণ হয়েই গেল শেষপর্যন্ত।তাও আবার এই চ্যাংড়াটা বসেছে তার পাশে!


 

২.

"হ্যালো?কেমন আছেন ভাই,সব ভালো তো?" চ্যাংড়াটা কাকে যেন কি বলছে।সুবিমলবাবু তাকিয়ে দেখলেন, চ্যাংড়াটা তো কারও সাথে কথা বলছে না,ফোনও তো করছে না!তাহলে কাকে বলছে?ওর পাশে তো সুবিমলবাবুই বসে আছেন।উনাকেই বলছেন কি?কিন্তু একটু আগেই তো আঙ্কেল বললো এখন আবার ভাই!সুবিমলবাবু ভাবতে বসলেন,"একে দেখে তো সুবিধের মনে হয় না,মাথার নাটবল্টু হয়তো ঢিলেঢালা, হয়তো এজন্যই ভাই আবার আঙ্কেলও বলছে।এমন লোকের সাথে কথা বাড়িয়ে কাজ নেই।" ভাবা শেষ করেই বলে ফেললেন,"ভালো,তুমি কেমন আছো?"

কিন্তু চ্যাংড়াটা কোনো পাত্তাই দিলো না!সুবিমলবাবু আবার ভাবলেন,"পাগল তো তাই!"

"ভাই, আপনি এত পাগলের মতো কথাবার্তা বলেন কেন?" চ্যাংড়াটা আবার বললো।সুবিমলবাবু বললেন,"আমি আবার কখন পাগলের মতো কথা বললাম?"

এবারও চ্যাংড়াটা কোনো পাত্তা দিলো না!সুবিমলবাবুও আর কোনো কথা বলেননি।কখন যে এই পাগলটার সান্নিধ্য থেকে মুক্তি পাবেন,সেই সময়টার অপেক্ষায় আছেন।

"ভাই,ভাই,ভাই আপনি যে কি হাসির কথা বললেন!" বলে চ্যাংড়াটা শুধুশুধুই হাসতে শুরু করলো!

"আমি আবার কি হাসির কথা বললাম!" ভ্রুঁ কুঁচকালেন সুবিমলবাবু। 

এখন আবার চ্যাংড়াটা সুবিমলবাবুকে বললো,"আরেহ্,আঙ্কেল, ওদিকে একটু চাপুন তো।"

এখন আবার আঙ্কেল বলছে! সুবিমলবাবু কিছু না বলে চেপে গেলেন। শুধু ভাবলেন,"আচ্চা পাগলের জ্বালায় পড়েছি তো!নিজেই কি না কি বলছে,নিজেই উত্তর দিচ্ছে!পাগলের যত্তসব কাণ্ড! কি ভেবে যে আজ বাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম,ধুর!"

"ভাই,শুনুন,পাগলামো ছাড়ুন তো এখন।ভালো হোন।বিয়েটিয়ে তো করতে হবে নাকি?"

সুবিমলবাবুর মেজাজটা এখন আর ঠিক রাখতে পারছেন না।অনেক সহ্য করেছেন।বাবার সমান একজনকে একবার ভাই একবার আঙ্কেল বলছে।তারপর আবার পাগল!অবিশ্যি পাগল তো নিজেকে পাগল বলবে না, অন্যকেই বলবে!কিন্তু তারওপর আবার সুবিমলবাবুকে বিয়ে করবার কথা বলছে!ছিঃছিঃছিঃ!

পাগলামো তো পাগলামো তারওপর আবার চ্যাংড়ামো!

"ভাই,ভালো থাকবেন সবসময়।"

"আমি তো ভালোই আছি, যদিও তোমার সাথে বসে সেই ভালো থাকা গেলো না দেখছি।" সুবিমলবাবু মুখটা বিকৃত করে বললেন। 

পাগলটা খুব বেঁচে গেছে।সুবিমলবাবুর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে হয়তো এতক্ষণে উত্তম-মধ্যম দিয়ে দিতো।সুবিমলবাবু কিছু বলেনওনি।সুবিমলবাবু এসবই ভাবছেন।

পাগল চ্যাংড়াটা এখন আবার চুলের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে কানের কাছে জায়গাটা চুলকাচ্ছে!পাগলই বটে! যা লম্বা চুল,কত উঁকুন পড়েছে,কে জানে!


 

কিন্তু একি!চ্যাংড়াটা তো কান চুলকাচ্ছিলো না!ও কান থেকে সাদা রঙের একটা হেয়ারবাড্ খুললো।তারমানে এই হেয়ারবাডে্র মাধ্যমেই ও কারও সাথে কথা বলছিলো!আর সুবিমলবাবু কত কি ভেবে ফেললেন!অবিশ্যি সুবিমলবাবুর কোনো দোষ নেই, ওর যা লম্বা চুল,তারজন্য তো ওটা দেখাই যাচ্ছিলো না!কিছু না বলে ভালোই করেছেন তিনি।নিজেকেই লজ্জ্বায় পড়তে হতো!


 

"এটা কি হলো!" সুবিমলবাবু মনে মনেই বিড়বিড় করে হাসতে লাগলেন।হঠাৎ করে হাসতে হাসতে তিনি বিষম খেলেন।তখন ওই চ্যাংড়াটাই ওর ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে দিলো সুবিমলবাবুকে।সুবিমলবাবু ঢগঢগ করে পানি খেয়ে ফেললেন। এখন বেশ ভালো লাগছে তার।অন্তত পাগলের সান্নিধ্যে তিনি এতক্ষণ ছিলেন না—এই ভেবে বেশ শান্তি পাচ্ছেন।

"না,ছেলেটা ভালোই।আর আমি ওকে কত কি মনে করেছি!"ভাবলেন সুবিমলবাবু। 

তারপর সুবিমলবাবু নিজে থেকেই ওই ছেলেটার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা-বার্তা বললেন।


 

৩.

" দাদা…ও দাদা…উঠুন না?নামবেন না নাকি?"—মৃদুভাবে কে যেন সুবিমলবাবুকে ডাকছে। সুবিমলবাবু চোখ মেলে দেখলেন বাসের হেলপার উনাকে ডাকছেন।

"নামবেন না?কখন থেকে ঘুমুচ্ছেন।" হেলপার বললেন।

"আমি এতক্ষণ ধরে ঘুমুচ্ছিলাম নাকি?" জিজ্ঞেস করলেন সুবিমলবাবু। বেশ অবাক হলেন,তিনি তো কখনো গাড়িতে ঘুমান না!

"হ্যাঁ।"

"অ…আচ্ছা।" বলে যেই ব্যাগটা নিয়ে নামতে যাবেন,অমনি সুবিমলবাবু দেখলেন উনার ব্যাগটা নেই!হাতের ঘড়িটাও নেই! সঙ্গে ওই চ্যাংড়াটাও গায়েব!

সুবিমলবাবু সব বুঝতে পেরে গেলেন।তিনি কখনো কোনো জার্নিতে তো ঘুমান না—এটা তার দীর্ঘদিনের অভ্যেস! আজ অভ্যেসটা কেন পাল্টে গেল,সেটাও বুঝতে পারলেন—সব ওই পানিরই ম্যাজিক!

সুবিমলবাবু সব বুঝতে পেরে নিজের মনে মনেই হাসছেন!কারণ,ওই ব্যাগে উনার এক-দুটো কাপড়-চোপড় ছাড়া তো আর কিছুই নেই,তাও তত দামি তো না!উনি জরুরি কিছু এসব ব্যাগে রাখেন না।যদিও ব্যাগটা দেখলে মনে হবে হয়তো দামি,কিন্তু ভেতরে তো ফাঁকা!আর ঘড়িটারও তো বেশি দাম না,১৬০ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন।সুবিমলবাবু টাকা-পয়সা খরচার ব্যাপারে বেশ খুঁতখঁতে, সোজা কথায় কিপটেই বলা যায়!দামাদামি করে ১৬০ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন।

আর তেমন জরুরি কিছু তো সাথেও আনেননি তিনি।যাচ্ছিলেনই তো একদিনের জন্যে।শুধু কিছু নগদ টাকা আর মোবাইলটাই সাথে এনেছেন। তাও তিনি টাকা রাখেন উনার প্যান্টের ভিতরের গোপন পকেটে আর মোবাইল রাখেন শার্টের ভিতরের একটা গোপন পকেটে,সবসময়ই। এবারও তাই করলেন।তিনি পুরনোকালের মানুষ কিনা!

সুবিমলবাবু তাড়াতাড়ি করে প্যান্ট-শার্টের গোপন পকেটগুলো হাতড়াতে লাগলেন।দেখলেন,সবকিছু ঠিক আছে কিনা,নাকি ওগুলোও ধাও মেরে দিয়েছে! না,ওগুলো ঠিক আছে।তাহলে নিশ্চিন্ত।

সুবিমলবাবু মুৃদুভাবে হাসতে হাসতে বাস থেকে নেমে গেলেন আর ভাবতে লাগলেন,"ওই ব্যাগে তুমি কিচ্ছু পাবে না, বাবা চ্যাংড়া!আরে,পাবে পাবে আমার পুরনো দুটো প্যান্ট-শার্ট,একটা ছিদ্র হওয়া সেন্ডো গেঞ্জি, একটা একটুখানি ছেঁড়া লুঙ্গি! হা…হা…হা।" মনে মনেই হাসতে লাগলেন।আজ তিনি বেশ গর্ববোধ করছেন, নিজের জন্য। আজ তার কিপটেমির জন্য চোরও ঠকে গেল!বাড়িতে গিয়েও তার কিপটেমির গুণগান সবাইকে শুনাবেন।সবাই তো সুবিমলবাবুকে কত কথা বলেছেন, তার কিপটেমির জন্য!তিনি খুব খুশি,হাঁটতে হাঁটতে 

আবার ভাবনায় ডুব দিলেন,"এই গরমে এত কষ্ট করে তোমার ধাও মারাটা ফাও হয়ে গেল,ইশ!মানুষ বুঝে ধাও মারা উচিত ছিল তোমার।তুমি আমার পকেট হাতড়ে কিছু পাওনি,হাহা রে!ওগুলো তো শুধু দেখাবার জন্যে,বাবা!শুধু ব্যাগটা নিলে? ওতে কিছু পাবে তো?হায়রে!তোমার ধাওটা ফাও হয়ে গেল?ধুর!"—সুবিমলবাবু হাসতে লাগলেন।হঠাৎ করে আবার উচট খেলেন।পাশ থেকে একজন বলে উঠলেন," পাগল নাকি দাদা?শুধু শুধু হাসছেন যে?"

অন্য সময় হলে সুবিমলবাবু ক্ষেপে যেতেন,আজ তিনি বেশ খুশি তাই হাসতে হাসতেই বললেন,"পাগল নই,পাগল হবে,ওই চোর।"

হাসি আটকাতে পারছেন না তিনি। চোরটার কথা মনে পড়লেই হাসছেন!ভাবছেন,যখন চোরটা ব্যাগ খুলে কিছু পাবে না,তখন কেমন লাগবে!তখনই তিনি হেসে ফেলছেন।হঠাৎ করে আবার তিনি বিষম খেলেন,একটা লোক পাশ থেকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললেন,"এই নিন দাদা,পানি।"

"পানি!ওটি আর খাবো না ভাই!এখন ঘুমালে চলবে না।"


 

এই বাস জার্নিটা সুবিমলবাবুর সারাজীবন মনে থাকবে।বিশেষ করে ওই চ্যাংড়া চোরটার হাসির কান্ড ও বোকামি চোরগিরির জন্যে! হায়রে চ্যাংড়া বোকা চোর!



~অনিক বিশ্বাস

 

||সুবিমলবাবুর সাথে ঘটে যাওয়া এই কাণ্ডটা ভালো লাগবে কিনা,জানি না।তবে এমন অনেক কান্ড তার সাথে ঘটেছে এবং ঘটবে!সামনে আসছে…পড়তে থাকুন।||

 


রিদা
তিনি এই গল্পটি পছন্দ করেছেন ।

প্রথম মন্তব্য লিখুন


মন্তব্য লেখার জন্য আপনাকে অবশ্যই লগ ইন করতে হবে


আপনার জন্য

পরীক্ষার পূর্বদিন

পরীক্ষার পূর্বদিন

সারাবছর ভালো করে পড়েনি প...

খাঁটি পাগল

খাঁটি পাগল

বিধূবাবুর কাছে এক পাগল এ...

ছোট দাদুর বাড়িতে কয়েকদিন.....(পর্ব ১)

ছোট দাদুর বাড়িতে কয়েকদিন.....(পর্ব ১)

ছোট দাদুর  বাড়িতে কয়েকদি...

আমি

আমি

              আমি       ...

নীল দ্বীপ (পর্ব২)

নীল দ্বীপ (পর্ব২)

ব্রেকফাস্ট শেষে মৃন্ময় ত...

ডাবল জিরো

ডাবল জিরো

অংক পরীক্ষায় একেবারে দুট...

কে তুমি

কে তুমি

                     "কে...

পাহাড়ের চূড়া

পাহাড়ের চূড়া

             পাহাড়ের চূড়...

আমি (পর্ব৫)

আমি (পর্ব৫)

বিচিত্র পৃথিবীর মাঝে বেঁ...

তুমি অনন্যা (পর্ব ৩)

তুমি অনন্যা (পর্ব ৩)

পর্ব ৩:একটু এগুনোর পর শা...

নীল দ্বীপ

নীল দ্বীপ

           লেখক :ইসরাত ই...

মাথা ব্যাথা

মাথা ব্যাথা

কপালের ডানপাশটা ব্যাথা ক...

যখন সন্ধ্যা নামে

যখন সন্ধ্যা নামে

প্রতিদিন যখন সন্ধ্যা নাম...

পাশের বিল্ডিং এর ছাদে...

পাশের বিল্ডিং এর ছাদে...

পাশের বিল্ডিং এর ছাদে......

নীল দ্বীপ (শেষ পর্ব)

নীল দ্বীপ (শেষ পর্ব)

মৃন্ময়ের বিয়ের সবকিছু ঠি...

বন্ধু

বন্ধু

রিজু,আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।...

আবার ফিরে দেখা

আবার ফিরে দেখা

   “ ঈপ্সিতা” ডাকটা শুনে...

অর্পন

অর্পন

ভোরের সূর্য উঠার ঠিক আগ ...

শুভ্র ও রাইসা

শুভ্র ও রাইসা

বিকাল বেলা বাহিরে মেঘ ডা...

প্রিয় মা

প্রিয় মা

  প্রিয় মা,কেমন আছো তুমি...